মেয়েটিকে চিনি না
২৮ পেরিয়েছি। একটা ভাল চাকুরী করি। এই শহরেই আছি ২৫বছর ধরে। বাবা-মা সাথেই থাকেন। আজকাল আমার জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছে। আমার পছন্দ ছিল একটা সময়, ৪বছর হয়ে গেছে সম্পর্ক নেই। এখনো খোঁজ রাখি, সে বিয়ে করে নিয়েছে। অনেকটা সময় ছিলাম সম্পর্কে, কিন্তু ভাল সময় সেই কিছুদিনই থাকে পরে সেটা বিভিন্ন রূপ পালটে বোঝা পরায় চলে আসে। আলাদা ইউনিভার্সিটি আলাদা রুটিন, অনেক কিছু মানিয়ে নিয়েই চলতে হয়েছে। ইউনিভার্সিটির শেষ বছরে আর কুলিয়ে উঠতে পারিনি। শেষে মেনে নিয়েছি। গত ৩বছরে চাকুরী আর নিজের জন্য কিছু করা এর মাঝেই সময় কেটে গেছে, বন্ধুদের আড্ডায় সময়ও খারাপ কাটে না। আমার এখন আর পছন্দ বলে আহামরি কিছু নেই। সব ভালো হলে, বাবা-মায়ের পছন্দ হলে, আমার মানা নেই।
অফিসের জন্য বের হচ্ছি। মা দরজা লাগাতে আসলো।
- শুভ্র, আজকে দুপুরে আসবি। আমরা কিন্তু মেয়ে দেখতে যাবো। - মা বলল।
- আচ্ছা। একটা কাজ করো না?
- হ্যাঁ বল।
- মামাকে সাথে নাও। আমি গাড়িটা রেখে যাই, তোমরা আমাকে নিয়ে নিও অফিসের সামনে থেকে। তাহলে আমার অপেক্ষায় তোমাদের বসে থাকতে হবে না।
- আচ্ছা ঠিক আছে।
মেয়ের বাড়ি পুরান ঢাকা। তবে এরা এখানের স্থানীয় না। আমার কাছে কথা বলার খুব একটা কিছু ছিল না। কারণ আমি কারোর পরীক্ষা নিতে আসিনি। শুনেছি মেয়ে একটা মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিতে চাকুরি করে। সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। আমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করল মেয়ের বাবা। ওনাদের কথা বলা খুবই শান্ত প্রকৃতির লুকিয়ে চুকিয়ে কথা বলা না। সাবলীল একটা পারিবারিক আড্ডার মত মনে হল। কোন ইন্টারভিউ ভাব ছিল না।
বাসায় ফিরে বাবা বললেন, ফ্রেশ হয়ে আমার রুমে আয় তো।
ফ্রেশ হয়ে ফ্রিজ থেকে কোল্ড কফিটা নিয়ে বাবার রুমে গেলাম। বাবা?
- হুম। আমার কিন্তু ওদের ভালোই লেগেছে। একটা কাজ কর, (মানিব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে আমাকে দিলো) মেয়েটার কার্ড, যদি ইচ্ছে হয় তাহলে কথা বার্তা বলে নে।
- (কেমন যেন একটা লাগছে। সত্যি বলতে একটু লজ্জা লাগছে )। ঠিক আছে বাবা। আমি তোমাকে দুদিনের মধ্যে জানাবো।
- আমি কিন্তু ওদের থেকে হ্যাঁ পেয়েছি। ওরা কয়েকদিন ধরেই তো খোঁজ খবর নিয়েছে।
- ওহ আচ্ছা। ঠিক আছে বাবা আমি যাই তাহলে।
- হ্যাঁ যা।
আমি কল দেইনি আর। আমি বিষয়গুলোর সাথে খুব একটা পরিচিত নই।
ওপাশ থেকে যেহেতু হ্যাঁ এসেছে। তাহলে মেয়েও সম্মতি আছে নিশ্চই। তাছাড়া সে স্বাবলম্বী মেয়ে অবশ্যই সে আমার সম্পর্কে জেনেছে।
পরের দুইদিন আমি আর সময় করে উঠতে পারিনি এসব ভাবতে। কাজের চাপে, সময় ফুরুৎ করে চলে গেল। ৫দিন কেটে যাবার পর। রাতে একদিন খাবার খেতে বসার পর মা আমাকে জিজ্ঞাসা করল, কিরে তুই বাবাকে বলেছিস ২দিনের মধ্যে জানাবি। কতদিন হল?
আমি যে সময় করে উঠতে পারিনি সেটা মাকে আর বললাম না। পরিবারের সময় মানে পরিবারের সময় আর কাজের সময় মানে কাজের সময়। দুটাকে গুলিয়ে ফেলা উচিত না।
আমি বললাম, মা আমি কাল সকালে জানাই?
মাঃ ঠিক আছে জানাস। মনে রাখিস, আমাদের বয়স হয়েছে। আমরা কিন্তু জোনাকির ব্যাপারটা জানতাম, তুই লুকিয়েছিস তাই বলে এই না আমরা জানতাম না। ওর সাথে তোর সম্পর্কটা ভেঙ্গে যাবার পর মনে হয়েছে, তোকে সময় দেয়া উচিত তাই দিয়েছি। এখন তোর উচিত Move on করা।
আমি তো অবাক, জোনাকির কথা মা-বাবা জানত।
আমিঃ আচ্ছা মা, আমি কাল সকালে জানাচ্ছি।
তাড়াতাড়ি খাবার শেষ করে নিজের ঘরে চলে গেলাম। আমি ভাববার জন্য সময় মাত্র আজকের রাত। নাদিমকে কল করলাম অনেকক্ষন কথা বললাম। নাদিম আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। আমার ব্রেকাপের সময় আমার পাশে থেকে আমাকে মানসিকভাবে ও সাপোর্ট দিতে ভোলেনি। ওর বিয়ে হয়েছে এখনো ১বছর হয়নি। অনেক কথা হল। আমার শুধু শুধু সময় ক্ষেপণ করে কোন লাভ হবে না এটা অন্তত বুঝেছি।
সকালে বাবা-মাকে উত্তরটা জানালাম অফিসে যাবার ঠিক আগে।
বাবা-মায়ের যেন তড় সইল না। তারা তখনই ওবাড়িতে কল দিয়ে জানিয়ে দিলো।
দুপুরে লাঞ্চ টাইমে আমি মেয়েটিকে কল দিলাম।
- হ্যালো?
- হ্যালো, স্নিগ্ধা বলছেন?
- হ্যাঁ, আপনি?
- আমি শুভ্র সরকার।
- শুভ্র সরকার !
- (আমার নম্বর নেই নাকি আমার নামও জানে না? ) আমি শুভ্র, আপনাদের বাসায় এসেছিলাম গত সপ্তাহে।
- ওহ আচ্ছা। Sorry, আমি সত্যি বুঝতে পারিনি। আপনি লেন লাইনে কল দিয়েছেন তো তাই বুঝে উঠতে পারিনি।
(নিজেকে একটা বোকা মনে হল, আমি দেখিইনি কার্ডে আলাদা করে পার্সোনাল নম্বর লেখা ছিল। )
- ওহ আচ্ছা। না ঠিক আছে, আমার ভুল।
- না সমস্যা নেই। তো কেমন আছেন?
- জ্বী ভাল। আপনি?
- হুম আমিও ভাল। সত্যি বলতে আমি অফিসে তো, আমি কি আপনাকে বাসায় গিয়ে কল দিতে পারি?
- জ্বি অবশ্যই। রাখছি তাহলে।
- আচ্ছা শুনুন, আমি আপনার উত্তরটা শুনেছি।
( আমি হেঁসে দিলাম, কি বলব !! চুপ করে রইলাম)
সে বলল, ঠিক আছে পরে কথা হবে।
- জ্বি।
কল কেটে দিলাম।
বিয়ের কথা শুরু হয়ে গেছে। মজার ব্যাপার এখানে যে, বিয়ের জন্য সময় পেলাম না। ১৫দিনের মধ্যে বিয়ে। লগ্ন নেই আর ৩মাসে। আমি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পরলাম। সবাই মিলে ঠিক করলেন বিয়ের জন্য কোন কমিউনিটি সেন্টার না। বিয়ের জন্য যেতে হল গ্রামে। সেদিকে আয়োজন আগে থেকেই শুরু হয়ে গেছে। কি যে দিন গেলো আমার। ১৫দিনে বিয়ে করে ঘরে বৌ, আর আমি অবিবাহিত থেকে বিবাহিত।
বৌভাত করে, ঢাকার ফিরলাম।
যার বিয়ে তার মাঝে তেমন কোন আনন্দ থাকে না। সব থাকে আশেপাশের মানুষের মাঝে।
কখন গেল বিয়ে, কখন গেল কালরাত, কখন গেল বাসর রাত কিছুই বুঝলাম না।
রাতের খাবার শেষে নিজের ঘরে গেলাম। একি আমার ঘরের চিত্রই পালটে গেছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমার মাথায় হাত। আমার বুক সেলফটা বিছানার পাশে নেই। বিয়ে করে কি পাপ করলাম আমি !
কিন্তু আমার বউ কোথায়? বারান্দায় গিয়ে দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে। কফি খায়। সে কফি পছন্দ করে আমিও করি তবে খুব বেশি খাই না।
আমি বললামঃ কি করছেন?
স্নিগ্ধাঃ বাহিরের পরিবেশটা দেখছি, আপনার বারান্দাতে রাস্তার আলো আসে। ভাল লাগে না।
- দরজা বন্ধ করে দিলে রুমে আসে না।
- হুম। কিছু কথা বলার ছিল।
- হ্যাঁ বলুন।
- আমি যখন বলব মাঝে বলবেন না। আমার শেষ হলে আপনি যা বলার বলতে পারেন।
- Okay.
- Actually I need some time. আমি স্কুল জীবনে একটা সম্পর্কে ছিলাম, সেটা বেশিদিন টেকেনি। আমি তখনই বুঝে গিয়েছিলাম আমাকে দিয়ে এসব প্রেম হবে না। আমার অতিরিক্ত যত্ন সহ্য হয়না। যাকে আমি মন থেকে কাছে টানতে পারিনা তার যত্ন আমার ঝামেলা মনে হয়। আমাকে একটু সময় দেবেন Kindly । নইলে আমি মানিয়ে নিতে পারব না। আপনি হয়ত বুঝতে পারছেন আমি কি বলছি।
- হুম বুঝতে পেরেছি।
- আমার ইনকাম আমি যেটুকু চাইব আমি সংসারে দেব। কিন্তু আমাকে বাধ্য করবে না কেউ। আমি যথেষ্ট mature তাই আমার কোথাও যাওয়া নিয়ে আপনার আপত্তি থাকবে না আশা করি। হ্যাঁ, আমার কথা শেষ আপনি এখন বলুন।
- আপনি কি সবসময় শাড়িই পড়বেন?
- না, এখন নতুন আপনাদের বাসায় এসেছি তাই পড়ছি। মাঝে মাঝে টি-শার্টও পরবো। আপনার কোন আপত্তি আছে?
- না, আপনি বাসায় কি পরবেন সেটা আপনার ওপর, এখানে আমি কি বলব!
- আন্টি তো বলেছেনই, ( জ্বিহ্বাটা সামান্য বের করে সামনের দাঁতগুলো দিয়ে চেপে ধরে বলল) oh sorry মা, মা বলেছেন আমাকে সব সময় শাড়ি পড়তে হবে না।
- আর হ্যাঁ, আমার আপনার টাকা পয়সা নিয়ে আপত্তি নেই। তবে আপনি যদি কোথাও বের হন বাসায় কাউকে বলে যাবেন নইলে বাবা-মার স্বভাব টেনশন করা।
- (আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রূ উপরে তুলে) আমাকে দেখে কি ছোট বাচ্চা মনে হয়, আমি কি এটা বুঝি না?
- আচ্ছা আপনার জন্মতারিখ কত?
- ভুলে গেছেন?
- হুম।
..................... কথা চলল আরো অনেকটা সময় ........................
একই বিছানার এপাশ হয়ে শুয়ে থাকা দুজন মানুষ, মাঝে মাঝে কথা হয় অনেক রাত পর্যন্ত। আমার একটা ভালো লাগা তৈরী হয়েছে। জোনাকির প্রতি আমার যে সামান্য একটা পিছুটান ছিল, সেটা ভুলতে শুরু করেছি আমি। তার চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, তার মাঝে একটা অবুঝ ভাব আছে। মাঝে মাঝে মনে হয় সে ইচ্ছে করেই করে এমনটা। তার weekend শনি-রবিবার। রবিবার সে লুচি ভাঁজে, যে লুচিটা ফুলে ওঠে সেটা সে আমাকে দেয়। আর মাঝে মধ্যে ধুম করে তার মায়ের সাথে দেখা করতে।চলে যায়। আর আমাকে বলে রাতে তাকে নিয়ে যেতে। তার গাড়ি নেই, সে রাতে একা বাসায় ফিরতে পারবে না। মায়ের রান্না কষা মাংস আমার সবসময় প্রিয় খাবার। হঠাৎ একদিন কষা মাংসের টেস্টটা অন্যরকম লাগল এটা স্নিগ্ধার রান্না করা।
একদিন সকালে বাবা-মা আমাকে ডেকে বলল, আমি যেন প্রতিদিন আসার পথে স্নিগ্ধাকে অফিস থেকে নিয়ে আসি। আমার তাহলে একটু ঘুরে আসতে হয়। কিন্তু তারা যখন বলেছে, আমি কিছু বলিনি।
আমার মাথায় তখন চিন্তা, এত সামান্য একটা কথা সে আমাকে না বলে, বাবা-মাকে দিয়ে কেন বলালো?
আমি জিজ্ঞাসা করতে চাইনি। সময় হলে সে নিজেই বলবে। মাঝে মাঝে আমি কাজে খুব ব্যস্ত হয়ে পরি। কথা কমতে শুরু করল। তার মাঝে প্রাণচাঞ্চল্য কমে আসছে। কি নিয়ে যেন ভাবে সে। মাঝে মাঝে ছাঁদে গিয়ে চৌবাচ্চার পেছনে গিয়ে বসে থাকে। ডাকতে এলে মনে হয় কাঁদছিল। কি এমন হল? আমার ওপর কি রাগ করে আছে?
২রা অক্টোবর সকালে অফিসে যাওয়ার সময় সে আমাকে পেছন থেকে ডেকে ঘরে নিয়ে আসলো। বলল, আজ সে অফিসে যাচ্ছে না, তাকে যেন আমি একটা স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে দিয়ে যাই। সেদিন তার জন্মদিনও ছিল। কিন্তু আমি wish করার পরও তার মুখে ছোট্ট একটা Thank you ছাড়া কিছুই ছিল না।
ভাবলাম আসার পথে একটা কেক নিয়ে আসব। সাথে গিফট। সুন্দর করে সাজালাম ঘর, সেও সাজলো, কিন্তু তার ভেতরে যে একটা গুমনামি আছে সেটা অন্যকেউ বুঝতে পারছে না আমি পারছি। সে হাঁসে সেটা ফেক, সে কথা বলে জড়িয়ে যায়। মাঝে মাঝে বারান্দার দরজা না লাগিয়েই ঘুমিয়ে যায়। রাত জেগে জেগে ল্যাপটপে কাজ করা মেয়েটা এখন আর কাজ করে না।
আমাকে কল না দিয়েই একদিন অফিস থেকে বাসায় চলে আসলো। আমি দাঁড়িয়ে আছি অফিসের সামনে, সে আসে না। কল করলাম। বেজেই যাচ্ছে কলও রিসিভ করছে না। আমি চিন্তিত, সাথে রাগান্বিতও। শেষে ১ঘন্টা পর মাকে কল দিলাম। মা আমাকে জানালো সে বাসায় চলে গেছে। আমি বাসায় ফিরলাম। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে। একটু ভারি গলায় মাকে বললাম, স্নিগ্ধা কোথায় মা?~ ও ছাঁদে।
- কখন গিয়েছে?
- অনেকক্ষণ । আচ্ছা শোন না বাবা, ওর কি যেন হয়েছে। ওর অনেক মন খারাপ। আমার সামনে প্রায় কেঁদেই ফেলেছিল। আজকে দুপুরে এসেছে, খায়নি। আমি একবার উপরে গিয়ে ডেকে এসেছি। বলেছে তুই আসলে খাবে।
আমার যত রাগ ছিল সব পানি।
-আচ্ছা মা আমি ওকে নিয়ে আসছি। তুমি খেয়েছো তো?
- হ্যাঁ আমরা তো আগেই খেয়ে নিয়েছি।
- আচ্ছা আমি যাচ্ছি ছাঁদের।
সে আমার ডাক শুনে বলল, আসুন আমি এখানেই (সে সেই চৌবাচ্চার পেছনে)। গিয়ে দেখি বসে আছে হাতে একটা রক্তজবা। আমি পাশে চৌবাচ্চায় হেলে বসলাম।
- কি হয়েছে আপনার? আমি প্রায় ১ঘন্টা অফিসের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। ফোন ধরেননি। তাছাড়া, প্রায় মাস খানেন ধরেই আপনাকে Upset দেখছি। ভেবেছিলাম আমাকে এমনি জানাবেন।
সে কিছুই বলছে না। আমার দিকে তাকালো, তার চোখে জল। হাত থেকে জবাফুলটা পাশে রেখে দিল। জল কপল গড়িয়ে চিবুকে পৌঁছে গেছে। আমি কখনো তার গালে ছুঁয়ে দেখিনি। নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। চোখ মুছে দিলাম। সে কাঁদছে, নিজেকে ধরা রাখা আমার জন্য যেন গোবর্ধন গিরি তুলে ধরার মত কঠিন হয়ে উঠল। তাকে আগে কখনো এভাবে কাঁদতে দেখিনি। তার গোলাপি বর্ণের ঠোঁটগুলো কাঁপছিল, তার কাজলটা চোখের জলের সাথে মিশে বয়স রেখা পর্যন্ত এসে ছড়িয়ে পরছে। যেন বর্ষার কালো মেঘ সামান্য কালো তাকে চোখের নিচে সাজিয়ে দিয়ে গেছে। তাকে ২৬বছরের না, ১০-১২বছরের বাচ্চা মেয়ে মনে হচ্ছে। কাউকে কাঁদতে দেখলেও যে তার এত প্রশংসা করা যায় সেটা আগে জানতাম না।
সে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি বললাম, এবার বল কি হয়েছে?
- আমার চাকুরিটা চলে গেছে। আমি কাল থেকে ঘরে বসে থাকব। আপনার জন্য শুধু রান্না করবো।
- চাকুরি গেছে তো কি হয়েছে? আবার অন্য একটা খুঁজে নেবে।
প্রথমবার আমি বুঝতে পারলাম স্বনির্ভর একজন মেয়ের সম্মান তার কাছে কতটা। মাথা উচু করে বাঁচার আনন্দ তার কতটা। আমি ছেলে, আসেপাশে সব ছেলের মতই আমিও চাকুরি করি। কিন্তু আজো আমাদের দেশে সব মেয়ে চাকুরি করে না। সবার থেকে তারা অনেক আলাদা নিজেকে গৃহিণী ছাড়াও অন্য পরিচয় দিতে তাদের কতটা আনন্দ হয়।
আমি পরে জানতে পেরেছি ওদের কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে নিজেদের কোম্পানি সরিয়ে নিচ্ছে কারণ বাংলাদেশে মাত্র ৪০% কর্মী বাংলাদেশি, বাকিরা বাহির থেকে আনতে হচ্ছে। তাই তারা কোম্পানি সরিয়ে নিচ্ছে। ও শুধু আমার জন্য কোম্পানির অফারে জার্মানি যায়নি। Resign করেছে।
বাসায় আছে মাসখানেক ধরে। এখন একটু স্বাভাবিক হয়েছে সে। আমাকে আজকাল তুমি করে বলে, আবার আমাকেও তুমি করে বলতে বলে। নতুন ১টা ইন্টারভিউ দিয়েছে, চাকুরি হয়ে যাবে ভাবছে।
আমি এখন বুঝতে পারি মাঝে মাঝে আমার গায়ের ওপর যে হাত দিয়ে ঘুমাতো সেটা ভুল করে ঘুমের মাঝে না। ইচ্ছে করেই করত। আমাদের কথা বলা আবার বেড়েছে, মাঝে মাঝে বারান্দায় বসে সে কথা বলার সময় হেঁসে আলতো করে গায়ের ওপর জরিয়ে পরে। হঠাৎ একদিন তাকে কল করতে গিয়ে দেখি, আগে যেখানে লেখা ছিল স্নিগ্ধা দত্ত, সেখানে লেখা আমার বউ। আমিও সুযোগ পেলে তার মুখের খুব কাছে থেকে কথা বলি।
সেদিন সে আমার অফিস টাইমে গাড়িতে উঠে বসল বলল, হাবি তোমার অফিসটা যেন কত তলায়?
আমি শুনে তো অবাক?
- ৫ তলায়, প্রতিদিন লাঞ্চ টাইমে ৬তলায় আসবে। একসাথে লাঞ্চ করব।
--------------------------------------------------------------------
অফিসের জন্য বের হচ্ছি। মা দরজা লাগাতে আসলো।
- শুভ্র, আজকে দুপুরে আসবি। আমরা কিন্তু মেয়ে দেখতে যাবো। - মা বলল।
- আচ্ছা। একটা কাজ করো না?
- হ্যাঁ বল।
- মামাকে সাথে নাও। আমি গাড়িটা রেখে যাই, তোমরা আমাকে নিয়ে নিও অফিসের সামনে থেকে। তাহলে আমার অপেক্ষায় তোমাদের বসে থাকতে হবে না।
- আচ্ছা ঠিক আছে।
মেয়ের বাড়ি পুরান ঢাকা। তবে এরা এখানের স্থানীয় না। আমার কাছে কথা বলার খুব একটা কিছু ছিল না। কারণ আমি কারোর পরীক্ষা নিতে আসিনি। শুনেছি মেয়ে একটা মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিতে চাকুরি করে। সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। আমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করল মেয়ের বাবা। ওনাদের কথা বলা খুবই শান্ত প্রকৃতির লুকিয়ে চুকিয়ে কথা বলা না। সাবলীল একটা পারিবারিক আড্ডার মত মনে হল। কোন ইন্টারভিউ ভাব ছিল না।
বাসায় ফিরে বাবা বললেন, ফ্রেশ হয়ে আমার রুমে আয় তো।
ফ্রেশ হয়ে ফ্রিজ থেকে কোল্ড কফিটা নিয়ে বাবার রুমে গেলাম। বাবা?
- হুম। আমার কিন্তু ওদের ভালোই লেগেছে। একটা কাজ কর, (মানিব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে আমাকে দিলো) মেয়েটার কার্ড, যদি ইচ্ছে হয় তাহলে কথা বার্তা বলে নে।
- (কেমন যেন একটা লাগছে। সত্যি বলতে একটু লজ্জা লাগছে )। ঠিক আছে বাবা। আমি তোমাকে দুদিনের মধ্যে জানাবো।
- আমি কিন্তু ওদের থেকে হ্যাঁ পেয়েছি। ওরা কয়েকদিন ধরেই তো খোঁজ খবর নিয়েছে।
- ওহ আচ্ছা। ঠিক আছে বাবা আমি যাই তাহলে।
- হ্যাঁ যা।
আমি কল দেইনি আর। আমি বিষয়গুলোর সাথে খুব একটা পরিচিত নই।
ওপাশ থেকে যেহেতু হ্যাঁ এসেছে। তাহলে মেয়েও সম্মতি আছে নিশ্চই। তাছাড়া সে স্বাবলম্বী মেয়ে অবশ্যই সে আমার সম্পর্কে জেনেছে।
পরের দুইদিন আমি আর সময় করে উঠতে পারিনি এসব ভাবতে। কাজের চাপে, সময় ফুরুৎ করে চলে গেল। ৫দিন কেটে যাবার পর। রাতে একদিন খাবার খেতে বসার পর মা আমাকে জিজ্ঞাসা করল, কিরে তুই বাবাকে বলেছিস ২দিনের মধ্যে জানাবি। কতদিন হল?
আমি যে সময় করে উঠতে পারিনি সেটা মাকে আর বললাম না। পরিবারের সময় মানে পরিবারের সময় আর কাজের সময় মানে কাজের সময়। দুটাকে গুলিয়ে ফেলা উচিত না।
আমি বললাম, মা আমি কাল সকালে জানাই?
মাঃ ঠিক আছে জানাস। মনে রাখিস, আমাদের বয়স হয়েছে। আমরা কিন্তু জোনাকির ব্যাপারটা জানতাম, তুই লুকিয়েছিস তাই বলে এই না আমরা জানতাম না। ওর সাথে তোর সম্পর্কটা ভেঙ্গে যাবার পর মনে হয়েছে, তোকে সময় দেয়া উচিত তাই দিয়েছি। এখন তোর উচিত Move on করা।
আমি তো অবাক, জোনাকির কথা মা-বাবা জানত।
আমিঃ আচ্ছা মা, আমি কাল সকালে জানাচ্ছি।
তাড়াতাড়ি খাবার শেষ করে নিজের ঘরে চলে গেলাম। আমি ভাববার জন্য সময় মাত্র আজকের রাত। নাদিমকে কল করলাম অনেকক্ষন কথা বললাম। নাদিম আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। আমার ব্রেকাপের সময় আমার পাশে থেকে আমাকে মানসিকভাবে ও সাপোর্ট দিতে ভোলেনি। ওর বিয়ে হয়েছে এখনো ১বছর হয়নি। অনেক কথা হল। আমার শুধু শুধু সময় ক্ষেপণ করে কোন লাভ হবে না এটা অন্তত বুঝেছি।
সকালে বাবা-মাকে উত্তরটা জানালাম অফিসে যাবার ঠিক আগে।
বাবা-মায়ের যেন তড় সইল না। তারা তখনই ওবাড়িতে কল দিয়ে জানিয়ে দিলো।
দুপুরে লাঞ্চ টাইমে আমি মেয়েটিকে কল দিলাম।
- হ্যালো?
- হ্যালো, স্নিগ্ধা বলছেন?
- হ্যাঁ, আপনি?
- আমি শুভ্র সরকার।
- শুভ্র সরকার !
- (আমার নম্বর নেই নাকি আমার নামও জানে না? ) আমি শুভ্র, আপনাদের বাসায় এসেছিলাম গত সপ্তাহে।
- ওহ আচ্ছা। Sorry, আমি সত্যি বুঝতে পারিনি। আপনি লেন লাইনে কল দিয়েছেন তো তাই বুঝে উঠতে পারিনি।
(নিজেকে একটা বোকা মনে হল, আমি দেখিইনি কার্ডে আলাদা করে পার্সোনাল নম্বর লেখা ছিল। )
- ওহ আচ্ছা। না ঠিক আছে, আমার ভুল।
- না সমস্যা নেই। তো কেমন আছেন?
- জ্বী ভাল। আপনি?
- হুম আমিও ভাল। সত্যি বলতে আমি অফিসে তো, আমি কি আপনাকে বাসায় গিয়ে কল দিতে পারি?
- জ্বি অবশ্যই। রাখছি তাহলে।
- আচ্ছা শুনুন, আমি আপনার উত্তরটা শুনেছি।
( আমি হেঁসে দিলাম, কি বলব !! চুপ করে রইলাম)
সে বলল, ঠিক আছে পরে কথা হবে।
- জ্বি।
কল কেটে দিলাম।
বিয়ের কথা শুরু হয়ে গেছে। মজার ব্যাপার এখানে যে, বিয়ের জন্য সময় পেলাম না। ১৫দিনের মধ্যে বিয়ে। লগ্ন নেই আর ৩মাসে। আমি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পরলাম। সবাই মিলে ঠিক করলেন বিয়ের জন্য কোন কমিউনিটি সেন্টার না। বিয়ের জন্য যেতে হল গ্রামে। সেদিকে আয়োজন আগে থেকেই শুরু হয়ে গেছে। কি যে দিন গেলো আমার। ১৫দিনে বিয়ে করে ঘরে বৌ, আর আমি অবিবাহিত থেকে বিবাহিত।
বৌভাত করে, ঢাকার ফিরলাম।
যার বিয়ে তার মাঝে তেমন কোন আনন্দ থাকে না। সব থাকে আশেপাশের মানুষের মাঝে।
কখন গেল বিয়ে, কখন গেল কালরাত, কখন গেল বাসর রাত কিছুই বুঝলাম না।
রাতের খাবার শেষে নিজের ঘরে গেলাম। একি আমার ঘরের চিত্রই পালটে গেছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমার মাথায় হাত। আমার বুক সেলফটা বিছানার পাশে নেই। বিয়ে করে কি পাপ করলাম আমি !
কিন্তু আমার বউ কোথায়? বারান্দায় গিয়ে দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে। কফি খায়। সে কফি পছন্দ করে আমিও করি তবে খুব বেশি খাই না।
আমি বললামঃ কি করছেন?
স্নিগ্ধাঃ বাহিরের পরিবেশটা দেখছি, আপনার বারান্দাতে রাস্তার আলো আসে। ভাল লাগে না।
- দরজা বন্ধ করে দিলে রুমে আসে না।
- হুম। কিছু কথা বলার ছিল।
- হ্যাঁ বলুন।
- আমি যখন বলব মাঝে বলবেন না। আমার শেষ হলে আপনি যা বলার বলতে পারেন।
- Okay.
- Actually I need some time. আমি স্কুল জীবনে একটা সম্পর্কে ছিলাম, সেটা বেশিদিন টেকেনি। আমি তখনই বুঝে গিয়েছিলাম আমাকে দিয়ে এসব প্রেম হবে না। আমার অতিরিক্ত যত্ন সহ্য হয়না। যাকে আমি মন থেকে কাছে টানতে পারিনা তার যত্ন আমার ঝামেলা মনে হয়। আমাকে একটু সময় দেবেন Kindly । নইলে আমি মানিয়ে নিতে পারব না। আপনি হয়ত বুঝতে পারছেন আমি কি বলছি।
- হুম বুঝতে পেরেছি।
- আমার ইনকাম আমি যেটুকু চাইব আমি সংসারে দেব। কিন্তু আমাকে বাধ্য করবে না কেউ। আমি যথেষ্ট mature তাই আমার কোথাও যাওয়া নিয়ে আপনার আপত্তি থাকবে না আশা করি। হ্যাঁ, আমার কথা শেষ আপনি এখন বলুন।
- আপনি কি সবসময় শাড়িই পড়বেন?
- না, এখন নতুন আপনাদের বাসায় এসেছি তাই পড়ছি। মাঝে মাঝে টি-শার্টও পরবো। আপনার কোন আপত্তি আছে?
- না, আপনি বাসায় কি পরবেন সেটা আপনার ওপর, এখানে আমি কি বলব!
- আন্টি তো বলেছেনই, ( জ্বিহ্বাটা সামান্য বের করে সামনের দাঁতগুলো দিয়ে চেপে ধরে বলল) oh sorry মা, মা বলেছেন আমাকে সব সময় শাড়ি পড়তে হবে না।
- আর হ্যাঁ, আমার আপনার টাকা পয়সা নিয়ে আপত্তি নেই। তবে আপনি যদি কোথাও বের হন বাসায় কাউকে বলে যাবেন নইলে বাবা-মার স্বভাব টেনশন করা।
- (আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রূ উপরে তুলে) আমাকে দেখে কি ছোট বাচ্চা মনে হয়, আমি কি এটা বুঝি না?
- আচ্ছা আপনার জন্মতারিখ কত?
- ভুলে গেছেন?
- হুম।
..................... কথা চলল আরো অনেকটা সময় ........................
একই বিছানার এপাশ হয়ে শুয়ে থাকা দুজন মানুষ, মাঝে মাঝে কথা হয় অনেক রাত পর্যন্ত। আমার একটা ভালো লাগা তৈরী হয়েছে। জোনাকির প্রতি আমার যে সামান্য একটা পিছুটান ছিল, সেটা ভুলতে শুরু করেছি আমি। তার চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, তার মাঝে একটা অবুঝ ভাব আছে। মাঝে মাঝে মনে হয় সে ইচ্ছে করেই করে এমনটা। তার weekend শনি-রবিবার। রবিবার সে লুচি ভাঁজে, যে লুচিটা ফুলে ওঠে সেটা সে আমাকে দেয়। আর মাঝে মধ্যে ধুম করে তার মায়ের সাথে দেখা করতে।চলে যায়। আর আমাকে বলে রাতে তাকে নিয়ে যেতে। তার গাড়ি নেই, সে রাতে একা বাসায় ফিরতে পারবে না। মায়ের রান্না কষা মাংস আমার সবসময় প্রিয় খাবার। হঠাৎ একদিন কষা মাংসের টেস্টটা অন্যরকম লাগল এটা স্নিগ্ধার রান্না করা।
একদিন সকালে বাবা-মা আমাকে ডেকে বলল, আমি যেন প্রতিদিন আসার পথে স্নিগ্ধাকে অফিস থেকে নিয়ে আসি। আমার তাহলে একটু ঘুরে আসতে হয়। কিন্তু তারা যখন বলেছে, আমি কিছু বলিনি।
আমার মাথায় তখন চিন্তা, এত সামান্য একটা কথা সে আমাকে না বলে, বাবা-মাকে দিয়ে কেন বলালো?
আমি জিজ্ঞাসা করতে চাইনি। সময় হলে সে নিজেই বলবে। মাঝে মাঝে আমি কাজে খুব ব্যস্ত হয়ে পরি। কথা কমতে শুরু করল। তার মাঝে প্রাণচাঞ্চল্য কমে আসছে। কি নিয়ে যেন ভাবে সে। মাঝে মাঝে ছাঁদে গিয়ে চৌবাচ্চার পেছনে গিয়ে বসে থাকে। ডাকতে এলে মনে হয় কাঁদছিল। কি এমন হল? আমার ওপর কি রাগ করে আছে?
২রা অক্টোবর সকালে অফিসে যাওয়ার সময় সে আমাকে পেছন থেকে ডেকে ঘরে নিয়ে আসলো। বলল, আজ সে অফিসে যাচ্ছে না, তাকে যেন আমি একটা স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে দিয়ে যাই। সেদিন তার জন্মদিনও ছিল। কিন্তু আমি wish করার পরও তার মুখে ছোট্ট একটা Thank you ছাড়া কিছুই ছিল না।
ভাবলাম আসার পথে একটা কেক নিয়ে আসব। সাথে গিফট। সুন্দর করে সাজালাম ঘর, সেও সাজলো, কিন্তু তার ভেতরে যে একটা গুমনামি আছে সেটা অন্যকেউ বুঝতে পারছে না আমি পারছি। সে হাঁসে সেটা ফেক, সে কথা বলে জড়িয়ে যায়। মাঝে মাঝে বারান্দার দরজা না লাগিয়েই ঘুমিয়ে যায়। রাত জেগে জেগে ল্যাপটপে কাজ করা মেয়েটা এখন আর কাজ করে না।
আমাকে কল না দিয়েই একদিন অফিস থেকে বাসায় চলে আসলো। আমি দাঁড়িয়ে আছি অফিসের সামনে, সে আসে না। কল করলাম। বেজেই যাচ্ছে কলও রিসিভ করছে না। আমি চিন্তিত, সাথে রাগান্বিতও। শেষে ১ঘন্টা পর মাকে কল দিলাম। মা আমাকে জানালো সে বাসায় চলে গেছে। আমি বাসায় ফিরলাম। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে। একটু ভারি গলায় মাকে বললাম, স্নিগ্ধা কোথায় মা?~ ও ছাঁদে।
- কখন গিয়েছে?
- অনেকক্ষণ । আচ্ছা শোন না বাবা, ওর কি যেন হয়েছে। ওর অনেক মন খারাপ। আমার সামনে প্রায় কেঁদেই ফেলেছিল। আজকে দুপুরে এসেছে, খায়নি। আমি একবার উপরে গিয়ে ডেকে এসেছি। বলেছে তুই আসলে খাবে।
আমার যত রাগ ছিল সব পানি।
-আচ্ছা মা আমি ওকে নিয়ে আসছি। তুমি খেয়েছো তো?
- হ্যাঁ আমরা তো আগেই খেয়ে নিয়েছি।
- আচ্ছা আমি যাচ্ছি ছাঁদের।
সে আমার ডাক শুনে বলল, আসুন আমি এখানেই (সে সেই চৌবাচ্চার পেছনে)। গিয়ে দেখি বসে আছে হাতে একটা রক্তজবা। আমি পাশে চৌবাচ্চায় হেলে বসলাম।
- কি হয়েছে আপনার? আমি প্রায় ১ঘন্টা অফিসের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। ফোন ধরেননি। তাছাড়া, প্রায় মাস খানেন ধরেই আপনাকে Upset দেখছি। ভেবেছিলাম আমাকে এমনি জানাবেন।
সে কিছুই বলছে না। আমার দিকে তাকালো, তার চোখে জল। হাত থেকে জবাফুলটা পাশে রেখে দিল। জল কপল গড়িয়ে চিবুকে পৌঁছে গেছে। আমি কখনো তার গালে ছুঁয়ে দেখিনি। নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। চোখ মুছে দিলাম। সে কাঁদছে, নিজেকে ধরা রাখা আমার জন্য যেন গোবর্ধন গিরি তুলে ধরার মত কঠিন হয়ে উঠল। তাকে আগে কখনো এভাবে কাঁদতে দেখিনি। তার গোলাপি বর্ণের ঠোঁটগুলো কাঁপছিল, তার কাজলটা চোখের জলের সাথে মিশে বয়স রেখা পর্যন্ত এসে ছড়িয়ে পরছে। যেন বর্ষার কালো মেঘ সামান্য কালো তাকে চোখের নিচে সাজিয়ে দিয়ে গেছে। তাকে ২৬বছরের না, ১০-১২বছরের বাচ্চা মেয়ে মনে হচ্ছে। কাউকে কাঁদতে দেখলেও যে তার এত প্রশংসা করা যায় সেটা আগে জানতাম না।
সে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি বললাম, এবার বল কি হয়েছে?
- আমার চাকুরিটা চলে গেছে। আমি কাল থেকে ঘরে বসে থাকব। আপনার জন্য শুধু রান্না করবো।
- চাকুরি গেছে তো কি হয়েছে? আবার অন্য একটা খুঁজে নেবে।
প্রথমবার আমি বুঝতে পারলাম স্বনির্ভর একজন মেয়ের সম্মান তার কাছে কতটা। মাথা উচু করে বাঁচার আনন্দ তার কতটা। আমি ছেলে, আসেপাশে সব ছেলের মতই আমিও চাকুরি করি। কিন্তু আজো আমাদের দেশে সব মেয়ে চাকুরি করে না। সবার থেকে তারা অনেক আলাদা নিজেকে গৃহিণী ছাড়াও অন্য পরিচয় দিতে তাদের কতটা আনন্দ হয়।
আমি পরে জানতে পেরেছি ওদের কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে নিজেদের কোম্পানি সরিয়ে নিচ্ছে কারণ বাংলাদেশে মাত্র ৪০% কর্মী বাংলাদেশি, বাকিরা বাহির থেকে আনতে হচ্ছে। তাই তারা কোম্পানি সরিয়ে নিচ্ছে। ও শুধু আমার জন্য কোম্পানির অফারে জার্মানি যায়নি। Resign করেছে।
বাসায় আছে মাসখানেক ধরে। এখন একটু স্বাভাবিক হয়েছে সে। আমাকে আজকাল তুমি করে বলে, আবার আমাকেও তুমি করে বলতে বলে। নতুন ১টা ইন্টারভিউ দিয়েছে, চাকুরি হয়ে যাবে ভাবছে।
আমি এখন বুঝতে পারি মাঝে মাঝে আমার গায়ের ওপর যে হাত দিয়ে ঘুমাতো সেটা ভুল করে ঘুমের মাঝে না। ইচ্ছে করেই করত। আমাদের কথা বলা আবার বেড়েছে, মাঝে মাঝে বারান্দায় বসে সে কথা বলার সময় হেঁসে আলতো করে গায়ের ওপর জরিয়ে পরে। হঠাৎ একদিন তাকে কল করতে গিয়ে দেখি, আগে যেখানে লেখা ছিল স্নিগ্ধা দত্ত, সেখানে লেখা আমার বউ। আমিও সুযোগ পেলে তার মুখের খুব কাছে থেকে কথা বলি।
সেদিন সে আমার অফিস টাইমে গাড়িতে উঠে বসল বলল, হাবি তোমার অফিসটা যেন কত তলায়?
আমি শুনে তো অবাক?
- ৫ তলায়, প্রতিদিন লাঞ্চ টাইমে ৬তলায় আসবে। একসাথে লাঞ্চ করব।
--------------------------------------------------------------------
Comments
Post a Comment