তুমি মোর জীবনের ভাবনা, হৃদয়ের সুখের দোলা (২)
টিপ টিপ করে চোখের পাতা খুলল অনুপ। অনেক সকাল হয়ে গেছে, ঘড়ি দেখার দরকার নেই, বাহিরের সূর্য স্বাক্ষ্য দিচ্ছে। উঠে বসল সে। বারান্দার কাছে যেতেই, একটা মেয়ে চুল শুকাচ্ছে।
না ভুলে যায়নি সে, গতকাল থেকে দোলা আর সে একই বাসায় থাকছে।
তবে এটা একটা অন্যরকম অনুভুতি, ভেজা চুলে দোলা মনে ভীষণ দোলা দিয়ে গেল।
একটু পেছনে তাকিয়ে দোলা বলল, ঘুম ভেঙে গেছে?
অনুপ- শেষ বিকেলে অস্ত যাওয়া লাল সূর্যটাকে তোমার কপালে আর আমাবস্যার তিমির থেকে তুলে আনা ভারী অন্ধকারকে তোমার চোখে তুলে দিলে যে রূপ তুমি ধারণ করবে, তাতে নিজেকে হারিয়ে খুজতে আর ভয় নেই আমার।
-পাগল একটা। যাও ফ্রেশ হয়ে নাও। আমার ক্লাস আছে। আমি বেরিয়ে পড়ব।
মুখটা বাঙলা পাঁচের মত করে অনুপ বলল, এত প্রশংসা করলাম তার এই জবাব?
-হাহাহা, Thank you. হয়েছে? এখন এত সময় নেই তোমার সাথে প্রেম করার, যাও।
অনুপ বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখে দোলা ব্যাগ নিয়ে রেডি, বেরিয়ে পড়বে।
-যাচ্ছো?
-হ্যাঁ। সকালে ভাত, ডিম আর ডাল। ক্লাসে যাবার আগে খেয়ে নিও। চলি, দরজা লাগিয়ে নাও।
-সাবধানে যেও।
-হুম।
অনুপের ইউনিভার্সিটি থেকে বাসা খুব একটা দূরে না। তবে যাবে কিনা বুঝতে পারছে না। আগামীকাল প্রজেক্ট এর একটা ফাইল জমা দিতে হবে।
মোবাইলটা বেজে উঠল।
-হ্যালো, রানা? -অনুপ
-মামা, কই তুই?
-বাসায়।
-ক্লাসে যাবি?
-দেখা যাক, বুঝতে পারছি না? তুই কোথায়?
-আমি বাসে। আরে চলে আয় ক্লাসে। আর প্রোজেক্ট নিয়ে কথা বলার আছে।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
"আসতে late হবে খেয়ে নিও। ভাত রান্না ঘরে, ফ্রিজে তরকারী রাখা আছে।"
বাসায় ফিরে দরজায় sticky note টা দেখে একটু অবাক হল দোলা, একটা মিষ্টি হাঁসি ফুটল মুখে। ফ্রেশ হয়ে, খেয়ে নিল।
দোলার দ্বিতীয় ভালবাসা হচ্ছে কোডিং। ঘরটা গুছিয়ে বসে পড়ল ল্যাপটপ নিয়ে।
{ওই ফোন ধর}{ওই ছেরী ফোন ধর}
সায়েমের কল। রিংটোনটা সায়েম নিজেই সেভ করেছে।
-হ্যাঁ, বল।
-দোস্ত, বাসায়?
-হুম।
-কি করস?
-কোড? যা বলবি তাড়াতাড়ি বল।
-কেন? ভাইয়ার সাথে বাসা নিছিস বলে, এখন আমরা কথা বলব না? ভাইয়া আছে নাকি পাশে?
-হুড় হুস।
-শোন একটা joke বলব।
-দাড়া, vulgar joke হলে শুনব না। তোর বেশিরভাগ joke-ই হয় খুব খারাপ হয়।
-আরে নাহ। কি হইছে শোন। তোদের আজ বললাম না, আমি দুই রাত ধরে ঘুমাই না। তো বিশাল একটা ঘুম দেবো ভেবে, ঔষুধের দোকানে গেছিলাম, sleeping pill কিনতে। গিয়ে বললাম, দোকানদার একটু ব্যস্ত ছিল। আমাকে ২মিনিট দাড়াতে বলেছে।
- Then?
-লোকটা আমার দিকে তাকিলো, তাকিয়ে একটা চোরা হাঁসি হাসল। বুঝলাম না ব্যাপারটা। তারপর, প্যাকেটে ২টা pill দিয়ে বলে, ৭২ঘন্টার মধ্যে। প্রথমে আমি বুঝি নাই।
-😂😂
-Birth control pill দিছে।
-হায়রে। লোকটা তোকে কি ভাবছে। 😂
-বল তো দেখি, আমি একটা বাচ্চা ছেলে।
-হইছে।
-আচ্ছা। পরে কথা হবে।
-হ্যাঁ, যা অন্যদেরও শোনা ।
-টাটা।
-বাই।
আবার কাজে এ মনোযোগ দিল সে।
কখন যে সময় যায় বোঝাই যায় না। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠল। দোলা খেয়াল করল, ৮টা বেজে গেছে। অনুপ চলে এসেছে, মনে হয়।
নাহ। অনুপ না। বাড়িওয়ালা। আস্তে করে দরজা খুলল সে। যদিও সে বাসায় একা কিন্তু দরজার বাহিরে দাড় করিয়ে রাখাটা বাজে লাগে তাই ভেতরে আসতে বলল।
-সব গুছিয়ে নিয়েছেন?
-জ্বী চাচা।
-কোন সমস্যা হচ্ছে না তো?
-না। তবে, রান্না ঘরের জানালার কাচটা ভাঙা, বৃষ্টি হলে তো সব ভিজে যাবে।
-আচ্ছা, পাল্টে দেয়ার ব্যবস্থা করছি। উনি কোথায়?
-জ্বী, এখনো আসে নি। চলে আসবে, রাস্তায় আছে মনে হয়।
-এডভান্সটা তো দিয়েছেন, কিন্তু ভাড়াটা বলছিলেন উঠে দেবেন।
-জ্বী, কালই দিয়ে দিবো ।
-জ্বী তাড়াতাড়ি দিলেই ভাল। আমি তাহলে উঠি এখন। আর আমি জানালা পাল্টানোর ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
সত্যি তো ও এখনো কেন আসছে না, ভাবতে ভাবতে কল দিল দোলা। রিং হয়ে কেটে গেল।
আবার কলিং বেলের আওয়াজ।
দরজা খুলল। অনুপ।
-বাসার নিচেই ছিলাম, তাই রিসিভ করিনি। একটু পানি খাওয়াবে?
-হুম।
ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানিটা এনে দিল।
-এত দেরী করলে?
পানিটা গিলে নিয়ে, অনুপ বলল, ক্লাস শেষে প্রোজেক্টের কাজটা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। তারপর বাজার করলাম। তাই একটু সময় লাগল।
-ও আচ্ছা।
-খেয়েছো?
-না। তুমি বিশ্রাম কর আমি ভাতটা করে নেই। তরকারী দুপুরেরটা আছে আর বেশি কিছু করতে পারব না।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
Dinner শেষে, কফি হাতে দোলার ঘরে ঢুকল, অনুপ। ঘরের এককোণায় পা মেলে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে সে।
-কফি করে আনলাম।
-ভাল করেছো।
-তুমি নিচে বসে আছো কেন?
-মাঝে মাঝে নিজেকে নিচে নামাতে ভাল লাগে।
এটার কোন ভাবার্থ আছে কিনা বুঝল না অনুপ।
-কাজ করছো?
-দেখতেই তো পাচ্ছো।
কফি শেষেও পাশে বসে আছে সে। দোলা খেয়াল করেছে, তবে এখন কাজটা করাই তার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কাপ দুটি নিয়ে উঠবে, এমন সময় দোলা হাতটা চেপে ধরে চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, কাপগুলো রেখে আবার এসে আমার পাশে বসবে। কথা আছে।
অনুপ- এখানে বসেই?
দোলা- না। পরে দেখা যাবে।
অনুপ অপেক্ষা করছে দোলার মুখে কিছু শোনার জন্য। কখন কাজ শেষ হবে।
ল্যাপটপটা ব্যাগে রেখে, অনুপের পাশে এসে বসল। হাতটা চেপে ধরে, কাঁধের ওপর মাথা রেখে বসে রইল কিছুক্ষণ।
কারো মুখে কোন শব্দ নেই।
পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় ধ্যান হচ্ছে, প্রেম। পুরো পৃথিবীর সকল নিস্তব্ধতা মিশে যায় একস্থানে।
নিস্তব্ধতা ভাঙল, "কিছু বলবে না?" -অনুপ
-জানো, আমার জীবনের প্রথম হিরোর নাম কি?
-কি?
-বাবা। রোজ সকালে আমি বাবার সাথে ঘুরতে বের হতাম, বড়দির ঘুম ভাঙত না। বাবা হাঁটত, আর আমি শিউলি ফুল তুলতাম।
-আমিও যেতাম, তবে একটা সময় মা আর যেতে দিত না। পড়তে আসার বাহানায় আমার ছেলেবেলা হারিয়ে গেছে শহুরে যানবাহনের কালো ধোঁয়ায়।
-আমি কাল তোমার সাথে এক বিছানায় ঘুমাতে ইতস্তত বোধ করছিলাম, কেন জানো?
-না। তবে আমি বুঝতে পেরেছিলাম।
-আমি আগে কখনো কারো সাথে বিছানা শেয়ার করিনি।
-হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি। আচ্ছা, আমরা কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করছি তোমার কষ্ট হচ্ছে না?
-হচ্ছে। আমার বিয়েতে মা হয়ত অনেক খুশি হত। আমাকে বলেছিল, আমার বিয়েতে মা-বাবা নাচবে।
-আচ্ছা? তুমি কি বাসায়, শাখা-সিঁদুর পড়বে?
-হ্যাঁ, কেন পড়ব না?
-খুব একটা প্রয়োজন নেই।
-একটা ঘটনা বলি।
-হুম।
-আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। মেজোকাকু হঠাৎ করেই মারা গেলেন। আমরা সবাই গেলাম কাকুর বাসায়। সারাদিন কান্নার রোল লেগেছিল, কাকুকে শশ্মানে তোলা হল। আর তখন কাকীমাকে নিয়ে যাওয়া হল, ওনার শাখা-বালা ভাঙতে হবে। আমি কাকীমার মুখের দিকে তাকিয়ে অনুভব করলাম উনি যেন ওনার মাঝে নেই। ওনার অস্তিত্ব যেন ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে, কাকুর প্রাণভোমরাটা যেন ওটার মাঝে লুকিয়ে ছিল।
অনুপ কিছুই বলছে না, অনুপের কল্পনায় ভাসছে সব।
দোলা বলতে থাকল, "আমি কোনদিন অনুভব করিনি, একজন মানুষের কাছে দু-টুকরো শঙ্খের এতটা মূল্য। মনে হচ্ছে, একজন নারীর শাখা-বালা না, ভেঙে দেয়া হচ্ছিল তার ভবিষ্যতের সব স্বপ্নগুলোকে।"
-এত কিছু ভাবো তুমি!
-জীবনটা এমন কেন? কেন একদিন আমি তোমাকে হারাবো চিরদিনের জন্য।
নিরবতা আবার জড়িয়ে নিল সবকিছুকে।
ভালবাসা, দ্বায়িত্ব ছাড়াও আরো অনেক কিছু থাকে একটা বিবাহিত জীবনে।
৩য় পর্ব আসছে..................
ভালবাসা, দ্বায়িত্ব ছাড়াও আরো অনেক কিছু থাকে একটা বিবাহিত জীবনে।
৩য় পর্ব আসছে..................
Comments
Post a Comment