একটি বাসের গল্প
বাসটি কুড়িল ফ্লাইওভারে উঠলো । বোঝা যাচ্ছে ড্রাইভার ভালো মুডে আছে তাই ফ্লাইওভারে উঠে মনের সুখে গাড়ি চালাচ্ছেন । পেছনে একটা ছোট পিকাপ এসে হর্ন দেয়াতে ড্রাইভার বাসটি বাম পাশে সরিয়ে পিকাপটিকে সাইড দিলো । পিকাপটির ড্রাইভার মোটেও ভালো মুডে নেই তাই ডান দিক থেকে যাওয়ার সময় সে হালকা বামে সরে গেল ফলে বাসের ড্রাইভার ভারসাম্য রাখতে না পেরে বাসটি দুইতলা সমান উঁচু ফ্লাইওভার থেকে নিচে পরে যাচ্ছে । নিচে একটা প্রাইভেট কার । গাড়িটি সরে গেল বাসটি পরতে পরতে ।
আমার মাথায় ধাম করে একটা শব্দ হলো এবং মনে হলো আমার শরীর একবার শূন্যে ভাসছে আরেকবার আছরে পরছে । আমার হাতে রিং চিপস এর একটা প্যাকেট ছিল । ফ্লাইওভারে ওঠার আগেই কিনেছিলাম । পানির বোতল টা দেখতে পাচ্ছিনা ।
মাথার বাম পাশে ভেজা ভেজা লাগছে । গায়ের হলুদ শাড়িটাও লাল হয়ে আছে । আজ ই প্রথম পরেছিলাম শাড়িটা । কারন আজ একটি বিশেষ দিন ছিল ।
কিছুদুরে আমার মতনই অন্য একটা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে । বাঁচার জন্য প্রাণপণ লড়াই করছে ।
বাসে ওঠার সময় দেখেছিলাম একজন ওকে হাত ধরে বাসে উঠিয়ে দিয়েছিল এবং বলেছিল "আজ তোমার সাথে না যেতে পারার জন্য সরি,কাল যাবো,আজ একটু কষ্ট করো" । আমি ভাবছি মেয়েটা আসলেই কি কষ্টটাই না করছে এখন । আমি চাইলেও তাকে সাহায্য করতে পারছিনা কারন আমার ডান হাত থেতলে গেছে এবং বাম হাত দিয়ে রক্ত ঝরছে ।
আমার পাশের সিটে এক দম্পতি বসে ছিল আর তাদের কোলে ছিল একটা বাচ্চা । মা তার বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে আছে । বাচ্চাটি এখন আর কাঁদছে না। মায়ের হাত তার মাথায় হাত বুলাতে থাকলো এবং একসময় নিথর হয়ে গেল । বাদাম বিক্রেতা যেই ছেলেটা সখ করে ফ্লাইওভার ঘুড়তে চেয়েছিল বাসে সে একটা সিটের নিচে পরে আছে । গলায় চাপ লেগে গাল বেয়ে রক্ত পরছে তার । ছেলেটা চোখে ভয় এবং দুঃখ নিয়ে তাকিয়ে আছে । ভয় হয়ত দূর্ঘটনার জন্য আর দুঃখ হয়ত ফ্লাইওভারটি পুরো ঘুড়ে দেখতে না পারার জন্য ।
রিং চিপস্ গুলো চারপাশে ছড়িয়ে আছে । আমার কেন জানি খুব ইচ্ছা করছে হাত দিয়ে নিজের থেতলে যাওয়া মুখটা স্পর্শ করতে । আমি পারছিনা । আমার চোখ ধীরে ধীরে ঝাপসা এবং বন্ধ হয়ে আসছে । আমি তবুও তাকিয়ে আছি সবার দিকে । আমি তাকিয়ে থেকে ভাবছি জীবন কত নিষ্ঠুর । আমাকে বাঁচতে দিলোনা ।
কিছুক্ষন পরেই মানুষ ভীড় জমাবে কৌতুহল নিয়ে । আমার থেতলে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে আফসোসের সুরে কিছু শব্দ ছুড়ে দিবে । আমার শাড়ির আঁচল পরে থাকবে ধুলোমেখে । মায়ের কোলে চিরিতরে ঘুমানো বাচ্চাটাকে তুলে নেয়া হবে । বাদাম বিক্রেতাকে দেখে ভাবা হবে "ছেলেটার পরিবারের কি হবে! কে উপার্জন করবে" ।
আমার বয়সী সেই মেয়েটার মায়া জড়ানো এবং চোখে বিষন্ন মাখা মুখটি ঢেকে যাবে সাদা কাপড়ের আড়ালে । কেউ হাত দিয়ে জোড় করে বন্ধ করে দিবে আমার চোখ । আমি আর তাকাবোনা । আমি আর দেখতে পারবোনা পৃথিবীকে যে পৃথিবী আমায় বাঁচিয়ে রেখেছিল এতগুলো বছর ।
লেখিকাঃ কাজী মিহিকা
Comments
Post a Comment