তিথীর গল্প (১)
লেখিকাঃ কাজী মিহিকা
তিথী দোতালার জানালা দিয়ে বাড়ির পাশের খালি জায়গাটার দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবছে তারা যখন প্রথম এই এলাকায় এসেছিল তখন কতটাই না অন্যরকম ছিল জায়গাটা।
বাড়ির সামনে কোন পাকা রাস্তা ছিলনা। চারিদিকে শুধু পানি। আর উপরে ছিল বাশ দিয়ে বানানো সাঁকো। সাঁকোর উপর দিয়ে হেঁটে স্কুলে যেত তিথী। এই সাঁকো পাড় হতে গিয়ে কতবার পড়ে স্কুল ড্রেস নষ্ট করে ফেলেছে।
স্কুলের সামনের রোডটা বালি ভর্তি। পানি পাড় হয়ে বালিতে পা রেখতেই চোখটা ঝাপসা হয়ে গেল, আম্মুর হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে স্কুলে ঢুকি।
আমাদের বাসার থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা জায়গা বালি আর ইট দিয়ে ভরাট করে রাখা হয়েছে, বিল্ডিং ভানানোর জন্য। সত্যিই একদিন দেখি বিশাল বিশাল মেশিন আনা হয়েছে। বিশাল গর্জনে, দানবীয় আওয়াজ তুলে চলছে মেশিনগুলো। আমি ভাবতে লাগলাম, একদিন তাহলে পালটে যাবে এলাকাটা, বিশাল বড় বড় বিল্ডিং উঠবে, পিচঢালা রাস্তা হবে। সাঁকো দিয়ে আর ডোবা পেরোতে হবে না। এই খুশিতে কল্পনার বিস্তৃতি আরো একটু বেড়ে গেলো, আর কচু পাতায় ব্যাঙের লাফানো দেখতে দেখতে আমার দিন কেটে যায়।
প্রায় রাতে তাকিয়ে থাকি, সেই বড় বিল্ডিংটার দিকে। শুনেছি, বিল্ডিংটা দশতলা হবে। এখন মাত্র স্ট্রাকচার দাড় করিয়েছে। সন্ধ্যার পর দেখা যায় ৬০ ওয়াটের হলুদ বাতিগুলো জোনাকির মতো জ্বলে আছে বিল্ডিং এর এদিকে ওদিকে। সেটার দিকে তাকিয়ে আপাতত আমি সময় পাড় করে যাই।
এখানে রাতভোর ব্যাঙ ডাকে। ব্যাঙের ডাকে ঘুম হয় না। বিরক্ত হয়ে জানালা লাগিয়ে দেই। ভ্যাপসা গরমে ভাইয়ার চেচামেচিতে আবার জানালা খুলে দেই। ঘরের ব্যাঙটাকে থামাতে বাহিরের ব্যাঙকে নিমন্ত্রণ দেই। এবার জানালা খুলতেই একটা ব্যাঙ লাফিয়ে ঘরে চলে আসে। আমি হুংকার দিয়ে অন্য ঘরে চলে যাই।
তখন আমাদের বিল্ডিংএর দোতালার কাজ চলছে, আমরা নিচতলায় থাকি । সারাক্ষণ দেখি পানির ভেতর থেকে মাছ উঁকি দিয়ে আমাকে দেখছে, এটা আমি খুব উপভোগ করি । তারপর আব্বুকে দিয়ে বাজার থেকে অনেকগুলো মাছ কিনে এনে পানিতে ছেড়ে দেই। সে কি আনন্দ আমার। মাছদের সাথে কথা বলি, মাছগুলো যেন আমার কথা সব শুনছে। এই খুশিতে সাঁকোর ওপর বসে পানিতে পা ডুবিয়ে রাখি, কথা বলি ওদের সাথে, খেতে দেই ওদের।
কলেজে উঠেছি, ইন্টার-ফাস্ট ইয়ার। এলাকা কিছুটা পাল্টেছে, একটু উন্নত হয়েছে। বেশ কিছু বিল্ডিং উঠেছে। আর সেই ১০তলা বিল্ডিংটার কাজ শেষ। ওখানে নাকি একটা বড় মার্কেট হবে। আর ৬তলে থেকে ফ্ল্যাট ভাড়া হচ্ছে। অত ওপরে কারা থাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে।
এখন আমরা দোতালায় থাকি। আমাদের বারান্দা থেকে দশতলা বিল্ডিংটা দেখা যায়। কিছু কিছু ফ্ল্যাটের লাইট জ্বলছে।
আমাদের বাসা থেকে দূরে আরেকটি বাড়ি হয়। সেখানে হাজী কাকা আর তার পরিবার থাকে। হাজীকাকার নাম আসলে হাজী না, তিনি আসলে সৌদি-আরবে থাকতেন। গতবছর হজ্ব শেষে ফেরার পর থেকে ওনার নাম হয়ে যায় হাজী কাকা। এলাকায় ছোট বড় সবার কাছে উনি হয় হাজী কাকা নয়ত, হাজী সাহেব।
হাজী কাকার বিল্ডিংটা আমাদেরটা থেকে সামান্য দূরে। বিল্ডিংগুলো দেখতে দেখতে পরিচয় হয়ে যায় হাজী কাকার মেয়ের সাথে। মাঝে মধ্যে কথা হত।
ভাইয়া তখন সবে মাত্র ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে । পাপিয়া আর আমার গল্পে ভাইয়াও মাঝে মধ্যে যোগ দিতো। হাজী কাকার একটা ছেলেও যে আছে তা আমি জানতাম না। ওনার ছেলে মেয়ে মিলিয়ে ছিল ৩ সন্তান। প্রবাল তাঁর সবচেয়ে বড় ছেলে; গতবছর বিমান দূর্ঘটনায় মারা গেছে। মেঝো-ছেলে পার্থ আর মেয়ে পাপিয়া; যে এখন আমার খুব ভাল বন্ধু। সেও ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে পরে তবে অন্য কলেজে।
পার্থর কথা আমি জানতেম না।
একদিন বাসার পাশের রাস্তায় পাইপের ওপর আমি আর পাপিয়া বসেছিলাম। হঠাৎ দেখি একটা মোটামুটি সুদর্শন ছেলে পাইপের উপর দিয়ে হাটছে। কানে হেডফোন গুজে।
আমি পাপিয়েকে বললাম, দেখ কেমন ভ্যাবলা। নিচের দিকে তাকিয়ে হাটছে তো হাটছেই। পিছন থেকে একটা ধাক্কা দিলেও টের পাবে না। সোজা ক্ষেতের ভেতর পরবে। পাপিয়া কিছু একটা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু বলার সুযোগ না দিয়েই উঠে দাড়ালাম। বললাম, কিরে তুই কি শুধু বসে বসে মজাই নিবি নাকি আমাকে হেল্প করবি? পাপিয়া মুচকি হাসলো।
আমি পাইপের পাশ দিয়ে হাটার বান করতে করতে এদিক ওদিক তাকিয়ে ফেলে দিলাম ছেলেটাকে হালকা পায়ের ধাক্কা দিয়ে । ক্ষেতের মধ্যে পড়ে কাঁদায় মাখামাখি হয়ে গেল ছেলেটার। খুব হাসতে ইচ্ছে হলেও হাঁসি আটকে তাকে টেনে তোলার জন্য হাত বাড়ালাম।
হাত ধরে সে কাঁদা থেকে উঠে আসতেই পাপিয়া আমার এসে পাশে দাড়ালো। পার্থ রাগান্বিত চোখে একবার আমার দিকে তাকালো। পাপিয়া আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। অথচ আমি সেই চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। কি যেন এক মায়া খুজে পেলাম। ওই চোখে রাগ থাকলেও কোথায় যেন ভালবাসা লুকিয়ে ছিল।
সেই চোখের মায়া আমি ভুলতে পারলাম না।
আমার এখন সেই চোখ নিয়ে মনের মাঝে উথাল পাথাল সৃষ্টি।
তিথী দোতালার জানালা দিয়ে বাড়ির পাশের খালি জায়গাটার দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবছে তারা যখন প্রথম এই এলাকায় এসেছিল তখন কতটাই না অন্যরকম ছিল জায়গাটা।
বাড়ির সামনে কোন পাকা রাস্তা ছিলনা। চারিদিকে শুধু পানি। আর উপরে ছিল বাশ দিয়ে বানানো সাঁকো। সাঁকোর উপর দিয়ে হেঁটে স্কুলে যেত তিথী। এই সাঁকো পাড় হতে গিয়ে কতবার পড়ে স্কুল ড্রেস নষ্ট করে ফেলেছে।
স্কুলের সামনের রোডটা বালি ভর্তি। পানি পাড় হয়ে বালিতে পা রেখতেই চোখটা ঝাপসা হয়ে গেল, আম্মুর হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে স্কুলে ঢুকি।
আমাদের বাসার থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা জায়গা বালি আর ইট দিয়ে ভরাট করে রাখা হয়েছে, বিল্ডিং ভানানোর জন্য। সত্যিই একদিন দেখি বিশাল বিশাল মেশিন আনা হয়েছে। বিশাল গর্জনে, দানবীয় আওয়াজ তুলে চলছে মেশিনগুলো। আমি ভাবতে লাগলাম, একদিন তাহলে পালটে যাবে এলাকাটা, বিশাল বড় বড় বিল্ডিং উঠবে, পিচঢালা রাস্তা হবে। সাঁকো দিয়ে আর ডোবা পেরোতে হবে না। এই খুশিতে কল্পনার বিস্তৃতি আরো একটু বেড়ে গেলো, আর কচু পাতায় ব্যাঙের লাফানো দেখতে দেখতে আমার দিন কেটে যায়।
প্রায় রাতে তাকিয়ে থাকি, সেই বড় বিল্ডিংটার দিকে। শুনেছি, বিল্ডিংটা দশতলা হবে। এখন মাত্র স্ট্রাকচার দাড় করিয়েছে। সন্ধ্যার পর দেখা যায় ৬০ ওয়াটের হলুদ বাতিগুলো জোনাকির মতো জ্বলে আছে বিল্ডিং এর এদিকে ওদিকে। সেটার দিকে তাকিয়ে আপাতত আমি সময় পাড় করে যাই।
এখানে রাতভোর ব্যাঙ ডাকে। ব্যাঙের ডাকে ঘুম হয় না। বিরক্ত হয়ে জানালা লাগিয়ে দেই। ভ্যাপসা গরমে ভাইয়ার চেচামেচিতে আবার জানালা খুলে দেই। ঘরের ব্যাঙটাকে থামাতে বাহিরের ব্যাঙকে নিমন্ত্রণ দেই। এবার জানালা খুলতেই একটা ব্যাঙ লাফিয়ে ঘরে চলে আসে। আমি হুংকার দিয়ে অন্য ঘরে চলে যাই।
তখন আমাদের বিল্ডিংএর দোতালার কাজ চলছে, আমরা নিচতলায় থাকি । সারাক্ষণ দেখি পানির ভেতর থেকে মাছ উঁকি দিয়ে আমাকে দেখছে, এটা আমি খুব উপভোগ করি । তারপর আব্বুকে দিয়ে বাজার থেকে অনেকগুলো মাছ কিনে এনে পানিতে ছেড়ে দেই। সে কি আনন্দ আমার। মাছদের সাথে কথা বলি, মাছগুলো যেন আমার কথা সব শুনছে। এই খুশিতে সাঁকোর ওপর বসে পানিতে পা ডুবিয়ে রাখি, কথা বলি ওদের সাথে, খেতে দেই ওদের।
কলেজে উঠেছি, ইন্টার-ফাস্ট ইয়ার। এলাকা কিছুটা পাল্টেছে, একটু উন্নত হয়েছে। বেশ কিছু বিল্ডিং উঠেছে। আর সেই ১০তলা বিল্ডিংটার কাজ শেষ। ওখানে নাকি একটা বড় মার্কেট হবে। আর ৬তলে থেকে ফ্ল্যাট ভাড়া হচ্ছে। অত ওপরে কারা থাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে।
এখন আমরা দোতালায় থাকি। আমাদের বারান্দা থেকে দশতলা বিল্ডিংটা দেখা যায়। কিছু কিছু ফ্ল্যাটের লাইট জ্বলছে।
আমাদের বাসা থেকে দূরে আরেকটি বাড়ি হয়। সেখানে হাজী কাকা আর তার পরিবার থাকে। হাজীকাকার নাম আসলে হাজী না, তিনি আসলে সৌদি-আরবে থাকতেন। গতবছর হজ্ব শেষে ফেরার পর থেকে ওনার নাম হয়ে যায় হাজী কাকা। এলাকায় ছোট বড় সবার কাছে উনি হয় হাজী কাকা নয়ত, হাজী সাহেব।
হাজী কাকার বিল্ডিংটা আমাদেরটা থেকে সামান্য দূরে। বিল্ডিংগুলো দেখতে দেখতে পরিচয় হয়ে যায় হাজী কাকার মেয়ের সাথে। মাঝে মধ্যে কথা হত।
ভাইয়া তখন সবে মাত্র ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে । পাপিয়া আর আমার গল্পে ভাইয়াও মাঝে মধ্যে যোগ দিতো। হাজী কাকার একটা ছেলেও যে আছে তা আমি জানতাম না। ওনার ছেলে মেয়ে মিলিয়ে ছিল ৩ সন্তান। প্রবাল তাঁর সবচেয়ে বড় ছেলে; গতবছর বিমান দূর্ঘটনায় মারা গেছে। মেঝো-ছেলে পার্থ আর মেয়ে পাপিয়া; যে এখন আমার খুব ভাল বন্ধু। সেও ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে পরে তবে অন্য কলেজে।
পার্থর কথা আমি জানতেম না।
একদিন বাসার পাশের রাস্তায় পাইপের ওপর আমি আর পাপিয়া বসেছিলাম। হঠাৎ দেখি একটা মোটামুটি সুদর্শন ছেলে পাইপের উপর দিয়ে হাটছে। কানে হেডফোন গুজে।
আমি পাপিয়েকে বললাম, দেখ কেমন ভ্যাবলা। নিচের দিকে তাকিয়ে হাটছে তো হাটছেই। পিছন থেকে একটা ধাক্কা দিলেও টের পাবে না। সোজা ক্ষেতের ভেতর পরবে। পাপিয়া কিছু একটা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু বলার সুযোগ না দিয়েই উঠে দাড়ালাম। বললাম, কিরে তুই কি শুধু বসে বসে মজাই নিবি নাকি আমাকে হেল্প করবি? পাপিয়া মুচকি হাসলো।
আমি পাইপের পাশ দিয়ে হাটার বান করতে করতে এদিক ওদিক তাকিয়ে ফেলে দিলাম ছেলেটাকে হালকা পায়ের ধাক্কা দিয়ে । ক্ষেতের মধ্যে পড়ে কাঁদায় মাখামাখি হয়ে গেল ছেলেটার। খুব হাসতে ইচ্ছে হলেও হাঁসি আটকে তাকে টেনে তোলার জন্য হাত বাড়ালাম।
হাত ধরে সে কাঁদা থেকে উঠে আসতেই পাপিয়া আমার এসে পাশে দাড়ালো। পার্থ রাগান্বিত চোখে একবার আমার দিকে তাকালো। পাপিয়া আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। অথচ আমি সেই চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। কি যেন এক মায়া খুজে পেলাম। ওই চোখে রাগ থাকলেও কোথায় যেন ভালবাসা লুকিয়ে ছিল।
সেই চোখের মায়া আমি ভুলতে পারলাম না।
আমার এখন সেই চোখ নিয়ে মনের মাঝে উথাল পাথাল সৃষ্টি।
Comments
Post a Comment